রোমান্টিক প্রেমের গল্প প্রেমের পরিনাম

গল্প: প্রেমের পরিণাম — ছাইদ ও লাবনী

গ্রামের ধুলোবালিমাখা সরু রাস্তা ধরে প্রতিদিন স্কুলে যেত ছাইদ। ছেলেটা চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের। পড়াশোনায় ভালো, স্বপ্ন বড় হয়ে একদিন অনেক কিছু করবে, এমনটাই মনে করত সবাই। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ায় একটু বেশি যত্নেই বড় হয়েছে।

তবে গ্রামের মানুষ জানত, ছাইদের চোখে সবসময় যে একটা মুখ ভেসে থাকে  সে মুখ লাবনীর।

লাবনী, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তার চেহারায় এক ধরনের স্নিগ্ধতা ছিল, আর মিষ্টি হাসিতে যেকোনো কঠিন মনও নরম হয়ে যেত। ছাইদের থেকে বয়সে সামান্য বড় হলেও, মনটা যেন একেবারে একরকম ছিল।

স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যেত। লাবনী হাসতে হাসতে বলত,
— “এই যে ছাত্র সাহেব, বইয়ের ভারে কাঁধ ভেঙে যাবে না তো?”
ছাইদ লজ্জায় মাথা নিচু করে বলত,
— “ভাঙলে আপনি তো আছেন স্যার, ঠিক করে দেবেন।”

এই টুকরো টুকরো কথোপকথনের মধ্যেই জমে ওঠে এক নীরব ভালোবাসা। কেউ কাউকে কিছু বলেনি, কিন্তু চোখের ভাষা বলে দিয়েছিল সব।

##

একদিন বিকেলে, গ্রামের পুকুর পাড়ে বসে ছাইদ সাহস করে বলেই ফেলল,
— “আপনাকে খুব ভালো লাগে, লাবনী আপু।”
লাবনী চমকে উঠলেও কিছু বলল না। শুধু মৃদু হাসি দিয়ে বলল,
— “তুই এখনো ছোট। আগে বড় হ, তারপর বুঝবি ভালোবাসা কী।”

ছাইদ জবাব দিয়েছিল,
— “ভালোবাসা কি বয়স দেখে আসে?”

সেদিনের পর থেকেই, ছাইদের মন পুরোপুরি লাবনীর হয়ে যায়।

##

কয়েক মাস পর, ছাইদের বাবা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে ঢাকায় পাঠাবেন পড়াশোনার জন্য। ছাইদ বিদায়ের আগে লাবনীর হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলে,
“এটা রেখে দিও। যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে অপেক্ষা করো। আমি ফিরে আসবো।”

লাবনী চুপ করে চিঠিটা নিয়ে নেয়। কিছু বলে না।

##

ঢাকায় ছাইদ নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতিদিন ঘুমানোর আগে চিঠির কথা মনে পড়ে, লাবনীর মুখ মনে পড়ে। সময় কেটে যায় — এক বছর, দু’বছর।

পরীক্ষা শেষ করে ছাইদ ফিরে আসে গ্রামে।

প্রথমেই খোঁজ নেয় লাবনীর। তখন সে জানতে পারে — লাবনীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

যেন মাথার ওপর বাজ পড়ল। কী করবে বুঝে না। দৌড়ে স্কুলে যায়। লাবনী তখনো স্কুলে পড়াচ্ছিল।

দু’জনের চোখে চোখ পড়ে, অজস্র অশ্রুতে সব বলে দেয়।

“তুমি তো কথা রেখো না,” কাঁপা গলায় বলে ছাইদ।
লাবনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ভালোবাসি তোকে ছাইদ। কিন্তু সমাজ, পরিবার, দায়িত্ব... এইসবের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারিনি।”
“তাহলে ভালোবাসার কোনো দাম নেই?”
 “ভালোবাসার দাম আছে ছাইদ। কিন্তু আমরা অনেক সময় সে দামের যোগ্য হই না।”

##

লাবনীর বিয়ে হয়। ছাইদ আবার ঢাকায় ফিরে যায়, পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢোকে। কিন্তু আর কখনো প্রেমে পড়ে না। কারও চোখে আর লাবনীর সেই উজ্জ্বলতা খুঁজে পায় না।

সে প্রতিদিন লাবনীর দেয়া সেই চিঠি পড়ে,  যেখানে লেখা ছিল,
“ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, সময় তার মূল্য দেয়।”

##

বহু বছর পর, এক সরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে যায় ছাইদ। স্কুলটিই ছিল যেখানে লাবনী একসময় পড়াতেন।

পুরোনো দেয়াল, পুরোনো বেঞ্চ  সব যেন লাবনীর কথা মনে করিয়ে দেয়।

হঠাৎ পেছন থেকে এক কণ্ঠস্বর “ছাইদ?”

ঘুরে দেখে, লাবনী। বয়স হয়েছে, মুখে ক্লান্তি, তবে চোখে সেই একই দীপ্তি।

 “তুমি এখনো চিঠিটা রেখেছো?”
ছাইদ বলল,
“হ্যাঁ। প্রতিদিন পড়ি। তুমিই তো বলেছিলে, সময় মূল্য দেবে।”
 “ভালোবাসা কি এখনো আছে?”
 “ভালোবাসা যদি একবার সত্যি হয়, সেটা কোনোদিন মরে না।”

লাবনী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“আমি ভুল করেছিলাম ছাইদ। তোমাকে ছেড়ে, নিজের মনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম।”

ছাইদ কেবল মুচকি হাসে।
 “ভালোবাসা মানে কাউকে বেঁধে রাখা নয়, তাকে মুক্ত করে দেওয়া।”

##

সেদিন সন্ধ্যায়, দুজন পুকুর পাড়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। পাখির ডাক, হাওয়ার দোলা, আর স্মৃতির ভার — সব মিলিয়ে একটা নীরবতা।

শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে ছাইদ চলে যায় শহরে।
লাবনী ফিরে যায় তার নীরব সংসারে।

কিন্তু দুজনের মনেই একটা তৃপ্তি থেকে যায়। কারণ তারা জানে, প্রেমের পরিণতি সবসময় বিয়ে নয়।
প্রেম যদি সত্যি হয়, সে থেকে যায় আজীবন — না বলা কথার মতো, চোখে জমে থাকা জলের মতো।


                                  শেষ


0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন